Thursday, August 9, 2012

স্মৃতির মনিকোঠায় - কুন্তল বিশ্বাস

আজ ৯ আগষ্টনেত্রকোণার বিপ্লবী কমরেড কুন্তল বিশ্বাসের ৬৬তম জন্ম বার্ষিকীবাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী এবং নেত্রকোণার বাতিঘরনামে খ্যাত কুন্তল বিম্বাস ১৪ জানুয়ারি ২০০২ শনিবার বিকাল ৩.৫০ মিনিটে সাতপাই নিজ বাসভভনে পরলোক গমন করেনরাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অন্যান্য গুনে গুনান্বিত ওই মানুষটি আমাদের মাঝে নেইগত বছর যখন আমরা ওই সৃজনশীল, আধুনিকমনস্ক মানুষটির ৬৫তম জন্মদিন পালন করেছিলাম তখন তিনি আমাদের মাঝে জীবিত ছিলেনতাঁর অভাব আজ আমরা নেত্রকোনাবাসী অনুভব করতে পারছিযে সমাজে রাজনৈতিক নেতার সততা, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ আর আর্দশের প্রতি নিষ্ঠার অবনতি ঘটেছে, সেই সমাজে আজীবন সংগ্রামী কমরেড কুন্তল বিশ্বাসের মতো রাজনীতিরবিদরা যে অচল, সেটা আজ বলার অপেক্ষা রাখে নাশোষন মুক্তির আদর্শে বিশ্বাসী কুন্তল বিশ্বাস এমন একজন মানুষ যিনি আজীবন বিশুদ্ধ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছেন এবং সেই সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত অবিরাম সংগ্রাম করে গেছেনরাজনৈতিক বিশ্বাসের সাথে ব্যক্তিগত জীবনযাপনের অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার আন্তরিক তাগিদে জাগতিক ভোগ বিলাস বিসর্জন দিয়ে আরিক অর্থে তিনি সাদা মাটা জীবন বেঁচে নিয়েছিলেনকুন্তল বিশ্বাসের জন্মের সাথে
এক ছোট খাট বেদনাময় ইতিহাস জড়িতকুন্তল বিশ্বাসের জন্মের কয়েক মাস আগে তাদের গ্রামের বাড়ীতে তাঁর পিতা দ্বারকানাথ বিশ্বাস ডাকাতদল কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে গুরুতর আহত হন এবং কুন্তল বিশ্বাসের জন্মের কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেনএ সংবাদ আতুঁড় ঘরে তাঁর স্ত্রীকে জানতে দেওয়া হয়নি এবং বাড়ীতে সেদিন কাউকে কাঁদতেও দেওয়া হয়নিফলে কুন্তল বিশ্বাস আজন্ম পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েই বড় হয়েছেন পরিবারের অন্যান্যদের স্নেহ মমতায়-ভালোবাসায়কুন্তল বিশ্বাসের শৈশব এবং কৈশোর ছিল আনন্দময়উব্ধাখালি নদীতে সাতার কাটা, নৌকা বেয়ে পাড়ার ছেলেদের সাথে একসংগে বর্ষাকালে স্কুলে যাওয়া, ফুটবল, কাবাডি, গোল্লাছুটসহ গ্রামের অন্যান্য খেলাধূলায় অংশগ্রহন, ফসলের মৌসুমে পারিবারিক কৃষি শ্রমিকদের জন্য মাথায় বয়ে খাবার নিয়ে যাওয়া, ঘোড়ার পিঠে করে অথবা গরুর গাড়ীতে করে ধান নিয়ে বাড়ীতে আসা; বৈশাখ মাসে আসন্ন ঝড় বৃষ্টির আশাংকায় দল বেঁধে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে মাচায় ধান তোলা; মোরগের লড়াই, মেষের পাঁঠার লড়াই এবং ষাঁড়ের লড়াই দেখতে যাওয়া, কবিগান, যাত্রাগান দেখতে যাওয়া ইত্যাদি কর্মকান্ড ছিল অশেষ আনন্দের উকৈশোরের শেষদিকে হঠা করেই এ আনন্দময় পরিবেশ ছেড়ে নেত্রকোনা শহরে চলে আসতে বাধ্য হওয়ায় তাঁর অবস্থাও দাঁড়ায় ফটিকের মতঅবশ্য বড়ভাই মৃণাল কান্তি বিশ্বাস ও বৌদি বিভা রানী বিশ্বাসের স্নেহ ভালবাসার পাশাপাশি দ্রুতই কিছু বন্ধু বান্ধব ও খেলাধূলা জুটে যাওয়ায় এ অবস্থা বেশি দিন স্থায়ী হয়নিনেত্রকোনা শহরের তকালীন বিখ্যাত পাঠস্থান দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির পর প্রথমদিকে স্কুলে মন না বসলেও স্নেহময় শিকমন্ডলীর শিক্ষা পদ্ধতি, স্কুলের শিক্ষার পরিবেশ, খেলাধূলার সুযোগ ইত্যাদির ফলে মন বসতে খুব একটা সময় লাগেনি

বড়ভাই ডাঃ মৃনাল বিশ্বাস ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মীবাসায় স্থানীয় কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দসহ আত্মগোপন কারী কেন্দ্রীয় নেতাদের ও যাতায়াত ছিলএমন পরিবেশে বেড়ে উঠা কুন্তল বিশ্বাস স্বাভাবিক ভাবেই ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েনফৌজদারি মামলা আত্মগোপন মামলার তারিখে নিয়মিত হাজিরা দেয়া ইত্যাদি জনিত উদ্বেগ উকন্ঠায় পড়াশোনায় যথেষ্ট ব্যাঘাত সত্বেও তিনি ১৯৬৩ খ্রীঃ দত্ত উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে এস.এস.সি পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হনসে বছর নেত্রকোনা দত্ত উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৪ জন, সরকারী বালিকা বিদ্যালয় থেকে ৩ জন এবং চন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয় ও আঞ্জুমান উচ্চ বিদ্যালয় থেকে একজন করে মোট ৯ জন শহরের স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে উর্ত্তীন হয়ে ছিলেনসে বছর বিভিন্ন কলেজে প্রথম বিভাগে উর্ত্তীণদের সুযোগ-সুবিধা ঘোষনা করেছিলতারপর ১৯৬৫ খ্রীঃ নেত্রকোনা সরকারী কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে দুটি লেটার সহ উর্ত্তীণ হন

ছাত্র রাজনীতির পাঠ শুরু হয়েছিল নেত্রকোনা থেকেইঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর সে পালে আরও হাওয়া লাগলোবিজ্ঞান বিভাগের কর্তৃপ যদিও ছাত্রদের রাজনীতি করার বিরোধী ছিলেন তথাপি নানাভাবে ম্যানেজ করে ছাত্র রাজনীতিতে অংশগ্রহন চলতেই থাকেঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার চারটি বছর লেখাপড়া, ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকান্ড কুন্তলবিশ্বাসের জীবন প্রবাহে পাশাপাশি চলতে থাকে৬৬ এর ৬ দফা, ৬৭ এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯ এর গনঅভ্যুত্থান এবং ৭০ এর নির্বাচনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে অন্যান্যদের মত কুন্তল বিশ্বাসেরও তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলতখন বিশ্বাবিদ্যালয়ে সেশন জট ছিলনাফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির তিন বছর পর ১৯৬৭ সালে  রসায়নে অনার্স এবং ১৯৬৮-৬৯ শিক্ষা বর্ষে দ্বিতীয় শ্রেণীতে এম.এস.সি পাশ করেনকমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে সাপ্তাহিক একতাপ্রকাশিত হলে পার্টির নির্দেশে তিনি একতায় যোগদেন এবং পার্টির সার্বনিক কর্মীর দায়িত্ব পালন করেনতিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যদের নিয়ে গঠিত বিশেষ গেরিলা বাহিনীর সদস্যদের আশ্রয় ও খাবারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন১৯৮০ সালে তিনি কেন্দ্রীয় পার্টির অনুমতি নিয়ে নেত্রকোনাতে পার্টি গড়ে তোলার জন্য নেত্রকোনায় চলে আসেনঢাকায় থাকাকালীন দুটি ঘটনার উল্লেখ প্রাসঙ্গিককালীন পার্টির সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য বর্তমানে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের অনুপ্রেরণায় একটি রাজনৈতিক গ্রন্থের অনুবাদ, ‘ ইথিওপিয়া এক অন্যান্য বিপ্লবের কাহিনীনামে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়আরেকটি ঘটনা হল কেন্দ্রীয় পার্টি প্রশিক্ষণের স্কুল লেলিন স্কুলএর দায়িত্ব পাওয়াসেখানে তিনি একজন কেন্দ্রীয় প্রশিকের দায়িত্ব পালন করেন
কুন্তল বিশ্বাস যখন ঢাকা থেকে নেত্রকোনায় স্থায়ীভাবে সাতপাই নিজবাসভবনে বসবাস করতে শুরু করেন, তখন থেকেই তার বাসভবন বাতিঘরেপরিণত হয়নেত্রকোনার সকল রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী তার বাসায় আড্ডা না দিলে যেন পেটের ভাত হজম হতনাঢাকা থেকে কোন রাজণৈতিক নেতা, সংস্কৃতি কর্মী নেত্রকোনায় আসলেই থাকা-খাবারের ব্যবস্থা হত কুন্তল বিশ্বাসের বাসায়রবীন্দ্র নজরুল, সুকান্তের জন্ম বার্ষিকীর আয়োজনের দায়িত্ব তিনি নিজে পালন করতেন এবং সেই দায়িত্ব পালন করতে যে অর্থের প্রয়োজন হত তাও তিনি বহন করতেনকুন্তল বিশ্বাসকে নতুন প্রজন্ম কাক্কুমনিবলে ডাকতেনওই ডাকটা তিনি খুবই পছন্দ করতেন

কুন্তল বিশ্বাস যে দিন মৃত্যুবরণ করেন, সেদিন যেন নেত্রকোনা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং অনেকেরই চোখ ভিজে গিয়েছিলকুন্তল বিশ্বাসের জন্মদিনে ছাত্রইউনিয়ন নেত্রকোনা জেলা সংসদ, বাতিঘর বিভিন্ন কর্মসূচীর আয়োজন করেছেকমরেড কুন্তল বিশ্বাসকে লাল সালাম

লেথক : আবুল কাইয়ুম আহম্মদ, রাজনৈতিক কর্মী

No comments:

Post a Comment